পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে
২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১২ এএম
পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও যোগাযোগ গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। ভারতনির্ভরতা ও ভারতীয় হেজিমনি মোকাবিলার জন্য এর বিকল্প নেই। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য যোগাযোগ, নিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারতের অধিপাত্যকে স্বাগত জানিয়ে দেশকে সম্পূর্ণ ভারতনির্ভরই করেননি, এর স্বতন্ত্র, স্বকীয়তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে নিক্ষেপ করেন। বিনা ভোটের নির্বাচনে জয় দেখিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে ভারতীয় সমর্থনের বিনিময়ে তিনি ভারতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক তৈরি করেন, যা ছিল কেবলমাত্র দেওয়ার, কোনো কিছু পাওয়ার নয়। স্বৈরশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে ভারত চাওয়া মাত্র সবকিছুই পেয়েছে। ট্রানজিট-করিডোর পেয়েছে, বন্দর ব্যবহারের অধিকার পেয়েছে, একতরফা বাণিজ্যের সুবিধা পেয়েছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীদের দমনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছে, অভিন্ন নদীর পানির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব পেয়েছে, সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে বাংলদেশি মেরে রেহাই পেয়েছে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার সুবিধায় কোনো প্রধানমন্ত্রী বা সরকার দেশ ও জাতির স্বার্থ এভাবে বিসর্জন দিতে পারে, তার কোনো নজির বিশ্বে নেই। শেখ হাসিনা খুব গর্ব করে এক সময় বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি ভারত সারা জীবন মনে রাখবে’। ভারতকে এভাবে দেয়া বা ভারতের এভাবে নেয়ার সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতত্তোর শেখ মুজিবের শাসনামলে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সেই একমুখী দেয়া বা নেয়ার সম্পর্ক পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। অনেকেরই স্মরণ আছে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতাশীন হওয়ার পর ভারতের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হওয়ার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ভারতনির্ভরতার বাহু একে একে ছিন্ন করেন। রুশ-ভারতের খপ্পর থেকে বের হওয়ার জন্য তিনি একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর, অন্যদিকে চীনসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে মধ্যপ্রচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট করার পদক্ষেপ নেন। তার আমলেই জনশক্তি রফতানি এবং গার্মেন্ট রফতানি এখন অর্থনীতির দুই শক্ত স্তম্ভ। জিয়াউর রহমান কৃষিতে বিপ্লব সাধন করেন, যার সুফল হিসেবে দেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।
জিয়াউর রহমান তার অধীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় বুঝে ছিলেন, ভারতীয় আধিপাত্যবাদের কবল থেকে যদি দেশকে মুক্ত রাখতে হয়, স্বাধীন-সার্বভৌম ও স্বনির্ভর দেশ হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হয়, তবে পূর্ব, পশ্চিমের সঙ্গে এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বেগম খালেদা জিয়া তার শাসনকালের শুরুতেই জিয়াউর রহমানের পদচিহ্ন ধরে হাঁটা শুরু করেন। তিনি পশ্চিমের ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সঙ্গে পূর্বমুখী সম্পর্ক গড়তে পূর্বমুখী নীতি অবলম্বন করেন। চীনসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তার পূর্বমুখী নীতি সমর্থনে সর্বত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে। স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের দরজা সস্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, বেগম খালেদা জিয়ার পূর্বমুখী নীতির মোকবিলায় ভারতও তখন পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে, যদিও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বেগম খালেদা জিয়ার পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বহুমুখী প্রাপ্তি ঘটতে পারে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠাই নয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিকাশ এবং পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা বাংলাদেশের জন্য উন্মোচিত হবে। বাংলাদেশ ভূঅবস্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের একদিকে আছে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অন্যদিকে আছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। বাংলাদেশ এই দু’অঞ্চলের মধ্যে সংযোগবিন্দু। এই কৌশলগত অবস্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ খুব সহজেই তার অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং আরো বিবিধ ক্ষেত্রে বিকাশ ত্বরান্বিত করতে পারে। ড. এমাজউদ্দিন আহমদ তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসমষ্টির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোর বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থান, জাতীয় নিরাপত্তার দাবি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জরুরি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতি স্বাভাবিক ও কাক্সিক্ষত। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যের রফতানি প্রসারের জন্য প্রয়োজন আন্তঃএশীয় সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে সংযোগ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। এ জন্য বাংলাদেশকে তার পূর্বদিকের প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ট অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরালো করা আবশ্যক। বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের দেশগুলোর একাংশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া শীর্ষে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতিও কম যায় না। চীন-জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। চীনের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। জাপানের সহযোগিতায়ও অনুরূপ কাজ চলছে। চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মকা- চলছে। গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে মাতারবাড়ি। হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব উন্নয়ন উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙ্গা করবে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা বাড়ছে। এসব মিলে বাংলাদেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে। সম্পর্কের বিস্তার ও গভীরতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতির সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও বৃদ্ধি পাবে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সামান্য সীমানা আছে। এই সুবাধে তাদের মধ্যে প্রতিরক্ষার সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ়। বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও বাড়বে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর চীন-জাপানসহ দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিস্তারের বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পতিত স্বৈরাচারের অনাগ্রহের কারণে অনেক দেশের সঙ্গেই বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিকশিত হতে পারেনি। পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়নে অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিয়ানমার। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের পূর্বমুখী অভিযাত্রায় মিয়ানমার প্রবেশ দ্বার। কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুবই নাজুক। সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা সমস্যাও রয়েছে, যার সঙ্গে বাংলাদেশ ওতপ্রোত সম্পৃক্ত। অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখানে শরণার্থী হিসাবে অবস্থান করছে। মিয়ানমারের বিষয়টি পাশে রেখেই পূর্বমুখী সংযোগ এগিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। এক্ষেত্রে চীন নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। অথচ, চট্টগ্রাম থেকে চীনের কুনমিং বেশি দূরে নয়। মিয়ানমার মাঝখানে। মিয়ানমারের সঙ্গে ট্রেন ও সড়ক যোগাযোগের পদক্ষেপ বহু আগেই নেয়া হয়েছে। যথাযথ কর্মকা-ের অভাবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। মিয়ানমারের সঙ্গে সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ আছে চীনের। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত রেললাইন ও সড়ক নির্মিত হলেই দু’দেশের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হতে পারে। আর সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের পূর্বমুখী সংযোগ বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়ে যেতে পারে। চীনই পারে এই আঞ্চলিক সংযোগ বাস্তবায়নে কার্যকর সহযোগিতা করতে। তবে বাংলাদেশকেই উদ্যোগী হতে হবে। আমরা আশা করবো, অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভিআইপি মর্যাদায় সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রীর রিমান্ড শুনানি!
খুনিদের গ্রেফতারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ
পেশাব করে টিস্যু ব্যবহারের অনেকক্ষন পরেও পেশাবের রাস্তা ভেজা থাকলে করণীয় প্রসঙ্গে।
সৈয়দপুরে বর্ধিত শুল্ক প্রত্যাহারের দাবিতে ফল ব্যবসায়ীদের মানববন্দন
সিলেটে ওবায়দুল কাদেরসহ ৭২ জনের বিরুদ্ধে মামলা
যাত্রাবাড়ীতে বাকপ্রতিবন্ধীসহ আপন দুই বোনকে ধর্ষণ, আটক ১
তিন বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করবে ইসি
আশুলিয়ায় ৬টি ইটভাটাকে ৩৬ লাখ টাকা অর্থদন্ড
গ্রামে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ জরুরি
অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন হস্তান্তর
বিস্কুটের উপর ভ্যাট বৃদ্ধি কেন?
বিএনপি বনাম নতুন রাজনৈতিক দল
সন্ত্রাসী হামলায় ধলাপাড়া রেঞ্জের বিট কর্মকর্তা ও বন প্রহরীসহ মারাত্মকভাবে আহত ৯
জামালপুরে ট্রাকচাপায় অটোরিকশার ৫ যাত্রীর মৃত্যু
পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে বিভ্রান্তি কাম্য নয়
জামায়াতে ইসলামী মানবিক ও দূর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চায়: ডা. শফিকুর রহমান
‘রক্ত দিয়ে ছাত্ররা যা অর্জন করেছে, তা তাদেরই রক্ষা করতে হবে’
পালিয়ে যাওয়া হাসিনা দেশের মাটিতে আসতে পারবে না : খায়ের ভূঁইয়া
সামরিক শক্তিতে মিয়ানমার-ইরাকের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ
সরব হওয়ার দিন